আজ আমরা জানবো পৃথিবীতে ভাষ্কর্য তৈরির সূচনা হলো যেভাবে!
বর্তমান যুগে বিভিন্ন রাস্তা, প্রতিষ্ঠান, সংস্থায় প্রায় জায়গায় বিভিন্ন আকৃতির মূর্তি ও মানুষের ভাস্কর্য আমাদের চোখে পড়ে। আর এটা যে কত বড় পাপ (অপরাধ) সে সম্পর্কে আমরা সবাই জানলেও তার গুরুত্ব দেই না।
পবিত্র কুরআন-হাদিসে এ সম্পর্কে বলা আছে, কোনো প্রাণীর-মূর্তি নির্মাণ করা বা ঘরে রাখা ইসলামী শরিয়তে কঠিন কবিরা গুনাহ ও হারাম। মূর্তি সংগ্রহ, মূর্তি সংরক্ষণ এবং মূর্তির বেচাকেনা ইত্যাদি সব বিষয় কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে বিধানগত কোনো পার্থক্য নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই পরিত্যাজ্য।
মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কুরআন মজিদ ও হাদিস শরিফে এ প্রসঙ্গে যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো মূর্তি ও ভাস্কর্য এই দুটোকেই বুঝানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ পবিত্র আল- কুরআন মজিদের সূরা হজের ৩০ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে-
ذَٰلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ حُرُمَـٰتِ ٱللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌۭ لَّهُۥ عِندَ رَبِّهِۦ ۗ وَأُحِلَّتْ لَكُمُ ٱلْأَنْعَـٰمُ إِلَّا مَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ ۖ فَٱجْتَنِبُوا۟ ٱلرِّجْسَ مِنَ ٱلْأَوْثَـٰنِ وَٱجْتَنِبُوا۟ قَوْلَ ٱلزُّورِ
That [has been commanded], and whoever honors the sacred ordinances of Allah – it is best for him in the sight of his Lord. And permitted to you are the grazing livestock, except what is recited to you. So avoid the uncleanliness of idols and avoid false statement,
এইটিই। আর যে কেউ আল্লাহ্র অনুষ্ঠানগুলোর সম্মান করে তাহলে সেটি তার প্রভুর কাছে তার জন্যে উত্তম। আর গবাদি- পশু তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে সে-সব ব্যতীত যা তোমাদের কাছে বিবৃত করা হয়েছে, সুতরাং তোমরা পরিহার করো অপবিত্র বস্তু অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার করো মিথ্যাকথন।’
.
উপরোক্ত এই আয়াত দ্বারা পরিষ্কার ভাবে সব ধরনের মূর্তি পরিত্যাগ করার এবং মূর্তিকেন্দ্রিক সব কর্মকাণ্ড বর্জন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, উপরোক্ত আয়াতে সব ধরনের মূর্তিকে ‘রিজস’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘রিজস’ শব্দের বাংলা অর্থ হলো – নোংরা ও অপবিত্র বস্তু। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, মূর্তি সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকান্ড পরিহার করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর অত্যাবশ্যকীয়।
পবিত্র আল-কুরআনের সূরা নূহ এর ২৩ নম্বর আয়াতে কাফের সম্প্রদায়ের অবস্থা বর্ণনায় বলা হয়েছে-
وَقَالُوا۟ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّۭا وَلَا سُوَاعًۭا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًۭا
And said, ‘Never leave your gods and never leave Wadd or Suwa’ or Yaghuth and Ya’uq and Nasr.
তারা বলছেঃ তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে ত্যাগ করো না এবং ত্যাগ করো না ওয়াদ, সূয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসরকে।
এখানে কাফের সম্প্রদায়ের দু’টি বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়েছে, তা হলো-
১) মিথ্যা উপাস্যদের পরিত্যাগ না করা।
২) মূর্তি ও ভাস্কর্য পরিহার না করা।
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটাই বুঝা যাচ্ছে যে, মিথ্যা উপাস্যের উপাসনার মতো ভাস্কর্যপ্রীতিও কুরআন মজিদে কাফেরদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত। অতএব এটা যে ইসলামে গর্হিত ও পরিত্যাজ্য তা তো বলাই বাহুল্য।
উপরের আয়াতে উল্লিখিত মূর্তিগুলো সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘এগুলো হচ্ছে নূহ আ:-এর সম্প্রদায়ের কিছু পুণ্যবান লোকের নাম। তারা যখন মৃত্যুবরণ করেছে তখন শয়তান তাদের সম্প্রদায়কে এই কুমন্ত্রণা দিয়েছে যে, তাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে মূর্তি স্থাপন করা হোক এবং তাদের নামে সেগুলোকে নামকরণ করা হোক। লোকেরা এমনই করল। ওই প্রজন্ম যদিও এসব মূর্তির পূজা করেনি কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকৃত বিষয় অস্পষ্ট হয়ে গেল এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাদের পূজায় লিপ্ত হলো।’ (সহিহ বুখারি হাদিস : ৪৯২)
মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কুরআনের ভাষায় মূর্তি ও ভাস্কর্য হলো বহুবিধ মিথ্যার উৎস। আল-কুরআনের সূরা আনকাবুত ১৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَوْثَٰنًا وَتَخْلُقُونَ إِفْكًا إِنَّ ٱلَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ لَكُمْ رِزْقًا فَٱبْتَغُوا۟ عِندَ ٱللَّهِ ٱلرِّزْقَ وَٱعْبُدُوهُ وَٱشْكُرُوا۟ لَهُۥٓ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
মূর্তি ও ভাস্কর্য যেহেতু অসংখ্য মিথ্যার উদ্ভব ও বিকাশের উৎস সুতরাং উপরোক্ত আয়াতে একে ‘মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াতগুলো থেকে পরিষ্কার জানা যাচ্ছে, মূর্তি ও ভাস্কর্য দু’টিই সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য।
পবিত্র হাদিস শরিফেও নবী করিম (সা) মূর্তি ও ভাস্কর্য সম্পর্কে পরিষ্কার বিধান দিয়েছেন।
(ক) হযরত আমর ইবনে আবাসা (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা:) বলেছেন ‘আল্লাহ তায়ালা আমাকে পাঠিয়েছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙে ফেলার এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তাঁর সাথে অন্য কোনো কিছুকে শরিক না করার বিধান দিয়ে।’
-(সহিহ মুসলিম হাদিস-৮৩২)
(খ) আবুল হাইয়াজ আসাদি বলেছেন, আলী ইবনে আবি তালেব (রা:) আমাকে বললেন, ‘আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য নবী সা: আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সব প্রাণীর মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সব সমাধিসৌধ ভূমিসাৎ করে দেবে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, … এবং সব চিত্র মুছে ফেলবে।’
-(সহিহ মুসলিম হাদিস-৯৬৯)
(গ) আলী ইবনে আবি তালেব ( রা:) বলেছেন, নবী করিম (সাঃ) একটি জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদিনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো প্রাণীর মূর্তি পাবে তা ভেঙে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধিসৌধ পাবে তা ভূমিসাৎ করে দেবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দেবে?’ আলী রা: এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হলেন। এরপর নবী সা: বলেছেন, ‘যে কেউ পুনরায় উপরোক্ত কোনো কিছু তৈরি করতে প্রবৃত্ত হবে সে মুহাম্মদের প্রতি নাজিলকৃত দ্বীনকে অস্বীকারকারী।’
-( মুসনাদে আহমাদ হাদিস-৬৫৭ )
(ঘ) উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা:) বলেন, নবী সা:-এর অসুস্থতার সময় তাঁর জনৈকা স্ত্রী একটি গির্জার কথা উল্লেখ করলেন। গির্জাটির নাম ছিল মারিয়া। উম্মে সালামা ও উম্মে হাবিবা ইতঃপূর্বে হাবশায় গিয়েছিলেন। তারা গির্জাটির কারুকাজ ও তাতে বিদ্যমান প্রতিকৃতিগুলোর কথা আলোচনা করলেন। নবী সা: শয্যা থেকে মাথা তুলে বললেন, ‘ওই জাতির কোনো পুণ্যবান লোক যখন মারা যেত তখন তারা তার কবরের ওপর ইবাদতখানা নির্মাণ করত এবং তাতে প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।’
-( সহিহ বুখারি হাদিস-১৩৪১ )
(ঙ) আবদুুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, প্রতিকৃতি তৈরিকারী (ভাস্কর, চিত্রকর) শ্রেণী হলো ওইসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদের কিয়ামত-দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।’
-( সহিহ বুখারি হাদিস-৫৯৫০ )
(চ) আবু হুরায়রা (রা:) নবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওই লোকের চেয়ে বড় জালেম আর কে, যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করার ইচ্ছা করে। তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে তারা সৃজন করুক একটি কণা এবং একটি শস্য কিংবা একটি যব!’
-(সহিহ বুখারি হাদিস-৫৯৫৩)
(ছ) আবদুুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, আমি মুহাম্মদ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, ‘যে কেউ দুনিয়াতে কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করে কিয়ামত-দিবসে তাকে আদেশ করা হবে, সে যেন তাতে প্রাণসঞ্চার করে অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না।’
-( সহিহ বুখারি হাদিস-৫৯৬৩)
উপরোক্ত মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কুরআনের আয়াত ও পবিত্র হাদিসগুলো থেকে প্রমাণিত হয়, মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন কবিরা গুনাহ। এটা এত বড় পাপ (অপরাধ) যে, তা- কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কুফরিরও পর্যায়ে পৌঁছে যায়।